Saturday, December 14, 2013

কোম্পানীগঞ্জ এবং নীলফামারীতে গুলি ও সংঘর্ষে নিহত ১৪ : মিছিলে গুলিতে কোম্পানীগঞ্জে নিহত ৮ : আসাদুজ্জামান নূরের গাড়িবহরে হামলা ও সংঘর্ষে নীলফামারীতে নিহত ৬

নোয়াখালী ও নীলফামারীতে নিরাপত্তা বাহিনীর নজিরবিহীন গুলি ও হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে গতকাল। এ দুই জেলায় পুলিশ ও র্যাবের গুলিতে কমপক্ষে ১৪ জন নিহত হয়েছে। এর মধ্যে নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জের আজকের হরতালের সমর্থনে বের করা শিবিরের মিছিলে র্যাব-পুলিশের নির্বিচার গুলিতে কমপক্ষে আট শিবিরকর্মী নিহত হয়েছে। এ সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে আমাদের প্রতিনিধি জানিয়েছেন। এ ঘটনায় আহত হয়েছে শতাধিক। হামলায় সশস্ত্রভাবে অংশ নেয় যুবলীগ ক্যাডাররা।
এদিকে নীলফামারী সদরে আওয়ামী লীগ দলীয় এমপি আসাদুজ্জামান নূরের গাড়িবহর থেকে বিএনপি নেতার বাড়িতে হামলা ও ভাংচুরের ঘটনাকে কেন্দ্র করে পুলিশের নির্বিচার গুলিতে অন্তত ৬ জন মারা গেছে। এদের মধ্যে জামায়াত, আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের তিন কর্মীর পরিচয় পাওয়া গেছে। বাকিদের পরিচয় তাত্ক্ষণিকভাবে পাওয়া যায়নি। এসব ঘটনাকে কেন্দ্র করে সংশ্লিষ্ট এলাকায় থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে।
গতকালের এ দুটি ঘটনা সাম্প্রতিককালে বিরোধী দলের নিরস্ত্র বিক্ষোভকারীদের ওপর নিরাপত্তা বাহিনীর অব্যাহত আগ্রাসনের ভয়াবহতম উদাহরণ। এর আগে একই স্থানে এতসংখ্যক নেতাকর্মীর নিহতের ঘটনা বিরল। গত দেড় মাসে সরকারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সরাসরি গুলিতে নিহতের সংখ্যা অর্ধশত ছাড়িয়ে গেল। আমাদের প্রতিনিধিদের পাঠানো খবরে বিস্তারিত :

কোম্পানীগঞ্জে পুলিশের গুলিতে ৮ শিবিরকর্মী নিহত
নোয়াখালী প্রতিনিধি জানান, পুলিশের নির্বিচার গুলিতে নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জে অন্তত আট শিবিরকর্মী নিহত হয়েছে। নিহতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। আহত হয়েছে শতাধিক নেতাকর্মী। কাদের মোল্লার ফাঁসির প্রতিবাদে দেশব্যাপী জামায়াতের আজকের হরতালের সমর্থনে মিছিল বের করা হলে উপজেলার বসুরহাটে এ ঘটনা ঘটে।
এর প্রতিবাদে আজ নোয়াখালীতে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল ডেকেছে শিবির।
এদিকে নিহতের খবর জানাজানি হলে ক্ষোভে ফেটে পড়ে জামায়াত-শিবির নেতাকর্মীরা। আগুন দেয়া হয় ১০টি সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। একইসঙ্গে ভাংচুর করা হয় ২৫-৩০টি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান।
অন্যদিকে ঘটনার পর ব্যাপক তাণ্ডব চালায় যুবলীগ-ছাত্রলীগ সন্ত্রাসীরা। তারা সন্ধ্যা পৌনে ৬টার দিকে কোম্পানীগঞ্জ মডেল হাইস্কুল ও কোম্পানীগঞ্জ কেজি স্কুল আগুনে পুড়িয়ে দেয়।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বসুরহাটে জামায়াত ও শিবিরকর্মীরা গতকাল বিকালে আজকের হরতালের সমর্থনে কোম্পানীগঞ্জ মডেল হাইস্কুল ও কেজি স্কুল রোড থেকে একটি মিছিল বের করে। মিছিলটি উপজেলার মসজিদের সামনে গেলে বাধা দেয় পুলিশ। এ নিয়ে জামায়াত-শিবির নেতাকর্মীদের মাঝে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। উত্তেজিত কিছু নেতাকর্মী পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করলে নির্বিচারে গুলি চালায় পুলিশ। এতে আট শিবিরকর্মী নিহত হয়। পুলিশের সঙ্গে এক পর্যায়ে হামলায় যুবলীগ ক্যাডাররাও আগ্নেয়াস্ত্রসহ অংশ নেয় বলে জানা গেছে।
গতরাতে এ রিপোর্ট লেখার সময় নিহতরা হলো—বামনীর নুর ইসলামের ছেলে সাইফুল ইসলাম (২৪), সিরাজপুর ইউনিয়নের চাঁড়াভিটির সফি উল্যাহর ছেলে রাসেল (২৩), বসুরহাট পৌর এলাকার নয়ন হাজী বাড়ির আবদুল রহমানের ছেলে সজীব (২৩), রায়হান (২৪) ও আবদুস সাত্তার (২৪), মতিউর রহমান (২২), রফিক (১৯)। বাকি একজনের পরিচয় জানা যায়নি।
থানায় পুলিশ হেফাজতে তিনজনের মৃতদেহ থাকার বিষয়টি নিশ্চিত করেছে পুলিশ। তবে তারা সর্বমোট মৃতের সংখ্যা নিশ্চিত করতে পারেনি।
এছাড়া এ ঘটনায় আহতদের গোপনে বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিত্সা দেয়া হচ্ছে বলে জানা গেছে।
একই ঘটনায় শিবিরকর্মীদের ইটপাটকেলের আঘাতে বশির, রাসেল ও রাজু নামে তিন পুলিশ কনস্টেবল আহত হয়েছে বলে জানা গেছে। তাদের প্রথমে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও পরে নোয়াখালী জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
এদিকে ঘটনার পর কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা ভূমি অফিস, বিআরডিবি ভবন, পোস্ট অফিস, সহকারী স্যাটেলমেন্ট অফিস, পরিবার পরিকল্পনা অফিস, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অফিস, আনছার অফিস, উচ্চ মাধ্যমিক ইঞ্জিনিয়ারিং অফিসে আগুন দেয়া হয় বলে জানা গেছে। পরে ফায়ার সার্ভিস এসে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে।
এছাড়াও শিবির কর্মীরা ২৫-৩০টি দোকানে ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ করে হয় বলে জানা গেছে। এ সময় পুলিশ ৮/১০টি ককটেল উদ্ধার করে।
এ ব্যাপারে কোম্পানীগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (তদন্ত) অভিযোগ করেন, শিবির ক্যাডার হেলাল প্রথমে পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলি করলে পুলিশ পাল্টা গুলি ছোড়ে।
এই রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত নোয়াখালী পুলিশ সুপার আনিছুর রহমান পিপিএমের নেতৃত্বে র্যাব, বিজিবি, পুলিশ, আনসার যৌথ অভিযান অব্যাহত রাখে। মৃতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে থানা সূত্রে জানা যায়।
নোয়াখালী পুলিশ সুপার আনিছুর রহমান পিপিএম জানান, শিবির কর্মীরা পুলিশের ওপর অতর্কিত গুলি বর্ষণ করলে পুলিশ আত্মরক্ষার্থে পাল্টা গুলি ছোড়ে। এ সময় পুলিশ শিবিরের ২০/২৫ জন নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করে।
প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে। অতিরিক্ত পুলিশও রয়েছে ঘটনাস্থলে।
এদিকে এ ঘটনার প্রতিবাদে নোয়াখালীতে রোববার সকাল-সন্ধ্যা হরতাল আহবান করেছে ছাত্রশিবির। শিবিরের নোয়াখালী শহর সভাপতি নেয়ামত উলল্গাহ শাকের হরতাল আহবান করেন।

নীলফামারীতে পুলিশের গুলিতে নিহত ৬
নীলফামারীতে আওয়ামী লীগ এমপি আসাদুজ্জামান নুরের গাড়ি বহর থেকে বিএনপি নেতার বাড়িতে হামলা ও ভাংচুরের ঘটনাকে কেন্দ্র করে পুলিশের নির্বিচার গুলিতে অন্তত ৬ জন মারা গেছেন। গতকাল সন্ধ্যা থেকে তিন ঘণ্টা ধরে পুলিশ ও আওয়ামী লীগের সঙ্গে ১৮ দলে নেতাকর্মীদের সংঘর্ষ হয়। এতে দু’পক্ষের শতাধিক নেতাকর্মী আহত হয়েছে। নীলফামারী সদর উপজেলার রামগঞ্জ বাজারে এ ঘটনা ঘটে।
নিহতদের মধ্যে ৩ জনের পরিচয় নিশ্চিত হওয়া গেছে। তারা হলেন জামায়াত কর্মী আবু বক্কর সিদ্দিক, ইউনিয়ন কৃষক লীগ সভাপতি খোরশেদ ও যুবলীগ কর্মী ফরহাদ।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, গত বৃহস্পতিবার সদর উপজেলার লক্ষ্মীচাপ ইউনিয়নের লক্ষ্মীর বাজারে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে একটি সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনার জেরে স্থানীয় বাজারে অগ্নিকাণ্ডের ফলে অন্তত ৪০টি দোকান ভস্মীভূত করা হয়। গতকাল স্থানীয় সংসদ সদস্য আসাদুজ্জামান নূর একটি গাড়ি বহর নিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন শেষে বাজারে প্রতিবাদ সমাবেশ করেন। সমাবেশ শেষে তারা রামগঞ্জ বাজার দিয়ে জেলা সদরে ফেরার পথে নূরের গাড়ি বহরে থাকা কিছু আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী স্থানীয় গোলাম রব্বানী নামে এক বিএনপি নেতার বাড়িতে হামলা ও ভাংচুর করে। তাত্ক্ষণিকভাবে এলাকাবাসী ভাংচুরকারীদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সৃষ্টি করলে উভয়পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয়। পরে সরকারি দলের সঙ্গে পুলিশ, বিজিবি ও র্যাব এসে যোগ দেয়। তারা শত শত রাউন্ড টিয়ারশেল, রাবার বুলেট নিক্ষেপ করে। দু’-ঘণ্টাব্যাপী চলা এই ত্রিমুখী সংঘর্ষে অন্তত ৪০টি মোটরসাইকেল ভাংচুর, অগ্নিসংযোগসহ ৬ জন নিহত এবং শতাধিক আহত হয়েছে।
সংঘর্ষের মধ্যে জেলা সদরে জামায়াতের জেলা কর্মপরিষদ সদস্য মনিরুজ্জামান মন্টুর একটি ওষুধের দোকান ও তার একটি মোটরসাইকেল শোরুম ভেঙে লুট করে নিয়ে যায় আওয়ামী লীগের লোকজন। এ ঘটনায় শহর জুড়ে উত্তেজনা বিরাজ করছে। শহরে অতিরিক্ত পুলিশ ও বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে। এ রিপোর্ট লেখার সময় রাত ১০টা ২০ মিনিটে এলাকায় থেমে থেমে সংঘর্ষ চলছে।
ভাংচুর ও লুটপাটের ছবি তুলতে গিয়ে যায়যায়দিন পত্রিকার প্রতিনিধির ক্যামেরা ও মোবাইল ফোন কেড়ে নিয়ে ভেঙে ফেলে যুবলীগ কর্মী মোজাফফর হোসেন। এছাড়া সদরের বাদিয়ার মোড়, জলঢাকা উপজেলার মীরগঞ্জ বাজারে ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে।

No comments:

Post a Comment