Wednesday, November 20, 2013

সাঁথিয়ায় হিন্দুদের উপর হামলা হয় সরকারি দলের ছত্রচ্ছায়ায়:জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের পর্যবেক্ষণ

পাবনার সাঁথিয়া উপজেলায় সরকারি দলের ছত্রচ্ছায়ায় পূর্বপরিকল্পিতভাবে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা চালানো হয়েছে বলে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সরকারি দলের কর্মীদের চাঁদা দিতে অস্বীকার করার কারণেই ঘটনাটি ঘটেছে। এতে সংখ্যালঘুদের মধ্যে আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে।
২ নভেম্বর সাঁথিয়ার হিন্দু-অধ্যুষিত তিনটি গ্রামে হামলা ও লুটপাটের ঘটনার ওপর কমিশন এই পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদন তৈরি করে। ঘটনার প্রতিকারের জন্য প্রতিবেদনে ১০টি সুপারিশ করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, ঘটনা প্রতিরোধে পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থা ব্যর্থ হয়েছে। তবে এর সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন পাবনার পুলিশ সুপার।
আর পাবনা জেলা পরিষদের প্রশাসক ও জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি এম সাইদুল হক বলেছেন, ছাত্রলীগ-যুবলীগের দু-একজন কর্মী জড়িত ছিলেন।

জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমানের নেতৃত্বে চার সদস্যের একটি দল ৭ নভেম্বর ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন করে। পরে পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়। কমিশনের চেয়ারম্যান এই পর্যবেক্ষণ তুলে ধরে ১৪ নভেম্বর মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ মোশাররাফ হোসাইন ভূইঞাকে চিঠি দেন।
প্রতিবেদন ও চিঠিতে ঘটনার সূত্রপাত সম্পর্কে বলা হয়েছে, ফেসবুকে নবী করিম (সা.) সম্পর্কে উপজেলার বনগ্রাম বাজারের ব্যবসায়ী বাবলু সাহার ছেলে রাজীব সাহা কটূক্তি করেছেন—এমন অভিযোগে কতিপয় যুবক ২ নভেম্বর কথিত ফেসবুকের কপি প্রিন্ট করে বাবলু সাহার বাড়িতে চড়াও হয়। তারা রাজীবকে তাদের হাতে তুলে দেওয়ার দাবি জানায়। পরে দুপুর ১২টায় বনগ্রাম বাজারে প্রতিবাদ সমাবেশ ডাকে। এ সময় সন্ত্রাসীরা বাবলু সাহার বাড়িসহ বনপাড়া বাজার, সাহাপাড়া ও ঘোষপাড়া গ্রামে হিন্দু সম্প্রদায়ের ৩০-৪০টি বাড়িতে হামলা, লুটপাট, ঘরবাড়ি ধ্বংসসহ দুটি মন্দির ভাঙচুর করে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, চাঁদা পেতে ব্যর্থ হয়ে ধর্মের নামে সাধারণ মানুষকে উত্তেজিত করে কিছু সুযোগসন্ধানী সংখ্যালঘুদের বাড়িতে এই হামলা, লুটপাট চালায়। যার পরোক্ষ প্রতিফলন হচ্ছে অর্থনৈতিকভাবে হিন্দুদের পঙ্গু করে ব্যবসা-বাণিজ্য বিনষ্ট করা। বাবলু সাহা নিয়মিত চাঁদা দিতেন। পুলিশ প্রশাসন যথাসময়ে ও যথাযথ ব্যবস্থা নিলে ঘটনার ভয়াবহতা অনেকটাই প্রতিরোধ করা যেত। কে ফেসবুকের কপি প্রিন্ট করে এর ফটোকপি করে বিতরণ করল, তা এখনো চিহ্নিত করা হয়নি। ঘটনাটি প্রতিরোধে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোও চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে।
অবশ্য পাবনার পুলিশ সুপার মিরাজউদ্দিন আহম্মেদ গতকাল সোমবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘ওই গুজব রটেছে সকাল ১০টার দিকে। কিন্তু তখন কেউ আমাদের জানায়নি। এরপর দুপুর ১২টার দিকে সমাবেশ শুরু হলে আমরা জানতে পারি। পুলিশ-র‌্যাব তৎক্ষণাৎ এলাকায় ছুটে গিয়ে ব্যবস্থা নেয়।’ তিনি বলেন, তিন-চার হাজার লোক জড়ো হয়েছিল। পুলিশ তাদের শান্ত করার সময় একটি দল হিন্দুপাড়ায় হামলা চালায়। এলাকায় চাঁদাবাজি সম্পর্কে তিনি জানান, এমন অভিযোগ কেউ তাঁদের কাছে আগে করেননি।
মন্ত্রিপরিষদের সচিবকে দেওয়া মিজানুর রহমানের চিঠিতে বলা হয়েছে, ঘটনার দিন প্রকাশ্যে রাস্তায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয়েছে এবং বাজারেও সভা আহ্বান করা হয়েছে। গোয়েন্দা সংস্থাগুলো কেন ঘটনার আগে তথ্য সংগ্রহ করে সরকারকে দিতে ব্যর্থ হয়েছে অথবা এই নারকীয় নাশকতা প্রতিরোধে কেন সরকারকে অবহিত করেনি, তারা কার স্বার্থ রক্ষা করেছে, এ বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা প্রয়োজন। অন্যথায় এ-জাতীয় ব্যত্যয় ঘটিয়ে সংস্থাগুলো সরকারকে আরও বিপদে ফেলবে এবং দেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করবে।
চিঠিতে আরও বলা হয়েছে, রামু, বাঁশখালী, সাঁথিয়াসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে হামলার বিষয়ে সংবাদ সংগ্রহ এবং তা সরকারকে দিতে গোয়েন্দা সংস্থার চরম ব্যর্থতা রয়েছে। মতবিনিময়ে স্থানীয় জনগণ তাঁকে বলেছেন, ঘটনার সময় পুলিশের ও স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের ভূমিকা ছিল সন্দেহজনক। তাঁরা তাঁদের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন। ঘটনার পরপরই দুটি মামলা করা হলেও দুর্বৃত্তরা এখনো রাজনৈতিক আশ্রয়ে ঘোরাফেরা করছে বলে স্থানীয় জনসাধারণ জানিয়েছেন। চিঠিতে বলা হয়, স্থানীয় লোকজন জানিয়েছেন, সাঁথিয়ায় হিন্দুদের নিয়মিতভাবে স্থানীয় সন্ত্রাসীদের চাঁদা দিতে হয়।
মিজানুর রহমানের চিঠিতে দ্রুত সেনাবাহিনীর মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের পুড়িয়ে দেওয়া ঘরবাড়ি ও মন্দির নির্মাণ এবং দোষী ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার করার নির্দেশনা দিতে মন্ত্রিপরিষদ সচিবকে অনুরোধ করা হয়। একই সঙ্গে প্রশাসন ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর ব্যর্থতা এবং রাজনৈতিক নেতাদের দুর্বৃত্তপনা প্রমাণিত হলে তাঁদের বিরুদ্ধেও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানানো হয়।
কমিশনের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, ঘটনার দিন হিন্দুদের রক্ষা করতে গিয়ে অনেক মুসলমান আহত হন বলেও স্থানীয় ভুক্তভোগীরা কমিশনকে জানিয়েছেন।
প্রতিবেদনে ১০ দফা সুপারিশ করা হয়েছে। এর মধ্যে আছে ভিডিও ফুটেজ দেখে প্রকৃত দোষী ব্যক্তিকে শনাক্ত করা, কারা ফেসবুকের কপি প্রিন্ট করে বিতরণ করল, মসজিদে কারা মাইকিং করে উসকানি দিল, তাদের চিহ্নিত করা এবং প্রচলিত আইন অনুযায়ী বিচারে সোপর্দ করা।
হামলায় সরকারি দলের ছত্রচ্ছায়ার অভিযোগ প্রসঙ্গে জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি এম সাইদুল হক বলেন, ‘আমাদের দলের কেউ কেউ থাকতে পারেন। ছাত্রলীগ-যুবলীগের দু-একজন আছেন, এঁরা কেউ পদধারী নন।’ তিনি বলেন, চাঁদাবাজির ঘটনাই হয়তো মূল বিষয়। স্থানীয় জামায়াত ও বিএনপির লোক এই হামলার সুযোগ নিয়েছেন। তদন্তে দলের কেউ জড়িত থাকার প্রমাণ থাকলে তাঁদের দল থেকে বহিষ্কার করা হবে।
http://www.prothom-alo.com/bangladesh/article/77128/%E0%A6%B9%E0%A6%BE%E0%A6%AE%E0%A6%B2%E0%A6%BE_%E0%A6%B9%E0%A6%AF%E0%A6%BC_%E0%A6%B8%E0%A6%B0%E0%A6%95%E0%A6%BE%E0%A6%B0%E0%A6%BF_%E0%A6%A6%E0%A6%B2%E0%A7%87%E0%A6%B0_%E0%A6%9B%E0%A6%A4%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%9A%E0%A7%8D%E0%A6%9B%E0%A6%BE%E0%A6%AF%E0%A6%BC%E0%A6%BE%E0%A6%AF%E0%A6%BC

No comments:

Post a Comment